লাইফস্টাইল ডেস্ক : পিত্তথলিতে পাথর হওয়া খুবই পরিচিত একটি সমস্যা। চারপাশের অনেকেরই কাছ থেকে এই অভিজ্ঞতা শোনা যায়। এই পাথর কি সত্যি সত্যি পথের কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি পাথরের মতো, নাকি অন্য কিছু? আর কীভাবেই বা সন্দেহ হবে যে পিত্তথলিতে পাথর হতে পারে আপনার? ‘পিত্তথলিতে পাথর‘ যাকে ইংলিশ এ আমরা বলি Gall Stone (Stone in gall bladder) আর চিকিৎসকের ভাষায় বলি Cholelithiasis.
পিত্তথলি কি ?
পিত্তথলি বা গলব্লাডার লিভারের সাথে সংশ্লিষ্ট পিত্তরস সম্পর্কিত তন্ত্রেরএকটি অঙ্গ। দেখতে একটি ছোট্ট থলির মতো। লিভারের ডান দিকের অংশের ঠিক নিচেএর অবস্থান। গলব্লাডার তার নিজস্ব নালী বা সিস্টিক ডারেক্টর মাধ্যমে মূলপিত্তনালী বা বাইলডাক্টের সাথে সংযুক্ত।লিভার থেকে নির্গত বাইল বা পিত্ত সাময়িকভাবে পিত্তথলিতে জমা থাকে। হজমক্রিয়ার প্রয়োজন মতো পিত্তথলির পিত্ত আবার পিত্তনালীর মাধ্যমে খাদ্যনালীতেনির্গত হয়। গলব্লাডার পিত্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে এবং ইলেকট্রোলাইটসেরপরিবর্তন করে। এই পিত্ত আমাদের হজমসহ খাদ্যনালীর অন্যান্য কাজে সহায়তা করেথাকে।
পাথর আসলে কী?
পিত্তথলির পাথর আসলে ছোট ছোট বালুর দানার মতো থেকে শুরু করে মটরের দানা বা তার চেয়েও বড় শক্ত দানাদার বস্তু, যা বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে। এটা নির্ভর করে কী পদার্থ দিয়ে পাথরটা তৈরি তার ওপর। কোলেস্টেরল, বিলিরুবিন বা ক্যালসিয়াম ইত্যাদি পদার্থের সংমিশ্রণে তৈরি এই পাথরগুলো পিত্তরসের সঙ্গে মেশানো অবস্থায় থাকে এবং হালকা বাদামি, ময়লাটে সাদা বা কুচকুচে কালো রঙেরও হতে পারে। পেটের ডানদিকে যকৃতের পেছনে ও তলার দিকে থাকে পিত্তথলি। পিত্তরস তৈরি করাই এর কাজ। খাবার হজমে, বিশেষ করে চর্বিজাতীয় খাবার হজম করতে পিত্তরস দরকার হয়। নানা কারণে এই পিত্তথলিতে বিভিন্ন পদার্থ অতিরিক্ত জমে গিয়ে পাথরের সৃষ্টি করে।
কাদের হয় বেশি?
স্থূল ও ওজনাধিক্য ব্যক্তিদের পিত্তথলিতে পাথর বেশি হতে দেখা যায়। পুরুষদের তুলনায় নারীদের এই প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া চল্লিশোর্ধ্ব বয়স, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাবার অভ্যাস, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কীভাবে বুঝবেন?
পিত্তথলির অবস্থানটা পেটের কোথায় তা আগেই বলা হয়েছে। পিত্তথলিতে পাথর হলে এতে প্রদাহ হয়, যাকে কোলেসিস্টাইটিস বলা হয়। তখন ওপর পেটের ডানদিকে তীব্র ব্যথা হতে পারে। মিনিট খানেক হতে ঘণ্টা খানেক স্থায়ী হতে পারে এই ব্যথা। পেটের পেছন দিকে, কাঁধে, পেটের মাঝ বরাবর এমনকি বুকের ভেতরও ছড়িয়ে পড়তে পারে ধীরে ধীরে। সেই সঙ্গে বমি ভাব বা বমি, হালকা জ্বর ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় পাথর পিত্তথলি থেকে বোরোতে গিয়ে পিত্তনালিতে আটকে যায় এবং তখন বিলিরুবিনের বিপাক ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন জন্ডিসও হতে পারে। রোগ নির্ণয়ের জন্য এই উপসর্গের পাশাপাশি পেটের আলট্রাসনোগ্রামই যথেষ্ট। পাথরের অবস্থান জানতে বা প্রয়োজনে বের করতে ইআরসিপি জাতীয় পরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে পেটের আলসার, যকৃতের কোনো সমস্যা বা এমনকি হূদেরাগেও কাছাকাছি ধরনের ব্যথা হতে পারে বলে সেগুলোর অবস্থাও নির্ণয় করে নেওয়া দরকার হয়।
চিকিৎসা কী?
প্রদাহ ও তীব্র ব্যথার সময় কোনো অস্ত্রোপচার করা হয় না। সাধারণত কয়েক দিনের জন্য মুখে খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দিয়ে স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে প্রাথমিক উপশমের চেষ্টা করা হয়। পরে পিত্তথলি ফেলে দেওয়ার অস্ত্রোপচারটি সপ্তাহ দুয়েক পর বা দু-তিন মাস পর করলেও ক্ষতি নেই। পেট কেটে বা ফুটো করে (ল্যাপারোস্কপিক) —দুভাবেই এই অস্ত্রোপচার করা যায়। তবে পিত্তনালিতে পাথর আটকে গিয়ে থাকলে ইআরসিপি যন্ত্রের সাহায্যে সেটি বের করে আনা হয়।
ল্যাপারোস্কপিক অপারেশন
১৯৮৭ সালে একজন ফরাসি সার্জন পেট না কেটে ল্যাপারোস্কপিক মেশিনের সাহায্যে পিত্তথলির অপারেশন শুরু করেন। অনেক চিকিৎসকের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও বর্তমানে পিত্তথলির অপারেশনে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি এটাই। সাধারণ অপারেশনের মতো এক্ষেত্রে পেটে লম্বা দাগ সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি হয় না জটিলতা।
স্রেফ রোগীকে অজ্ঞান করে পেটে চারটি ছিদ্র করে মেশিন ঢুকিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ করা যায় অপারেশন। একটি ছিদ্র দিয়ে টেলিস্কোপ ঢুকিয়ে ক্যামেরার সাহায্যে পেটের ভেতরের পুরো চিত্রটিই টিভি স্ক্রিনে নিয়ে আসা হয়। সেটা দেখে দেখে সার্জন নিপুণ দক্ষতায় পিত্তথলিকে অপসারণ করে থাকেন।
ল্যাপারোস্কপিক পদ্ধতির সুবিধা কী?
শরীরে কাটা দাগ না থাকাঃ ল্যাপারোস্কপিক সার্জারিতে দাগ থাকে না বললেই চলে।
সেলাই কাটার ভয় না থাকাঃ ল্যাপারোস্কপিক সার্জারিতে সেলাই কাটার কোনো বালাই নেই অর্থাৎ যেহেতু রোগীর ত্বকে কোনো সেলাই দেয়া হয় না তাই সেলাই কাটার প্রশ্নও ওঠে না।
ব্যথা কম হওয়াঃ ল্যাপারোস্কপিতে এ রকম ঝামেলা নেই বলে ব্যথাও হয় খুব নগণ্য।
সেলাই কাটার ভয় না থাকাঃ ল্যাপারোস্কপিক সার্জারিতে সেলাই কাটার কোনো বালাই নেই অর্থাৎ যেহেতু রোগীর ত্বকে কোনো সেলাই দেয়া হয় না তাই সেলাই কাটার প্রশ্নও ওঠে না।
ব্যথা কম হওয়াঃ ল্যাপারোস্কপিতে এ রকম ঝামেলা নেই বলে ব্যথাও হয় খুব নগণ্য।
খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্হায় ফিরে আসাঃ ল্যাপারোস্কপিক সার্জারিতে রোগী এক সপ্তাহের মধ্যে তার স্বাভাবিক কাজে ফিরে যেতে পারে। সাধারণ অপারেশনে কয়েকদিন রোগীকে না খেয়ে থাকতে হয় কিন্তু ল্যাপারোস্কপিক সার্জারিতে রোগী ৬-৭ ঘণ্টার মধ্যেই খাওয়া শুরু করতে পারে।
পিত্তথলিতে পাথর থাকা সত্ত্বেও যদি অপারেশান না করা হয় তবে যা যা হতে পারে ?
১ পিত্তথলির ইনফ্লেমেশান তথা Cholecyatitis – এর জন্য যেকোনো সময় আপনার পেটের ডান দিকে প্রচন্ড ব্যথাসহ জ্বর আসতে পারে এবং বমি ও হতে পারে।
২ অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস বা সার্জিক্যাল জন্ডিস – বাইল (পিত্তরস) পিত্তথলিতে জমা থাকে, চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া হলে বাইল পিত্তথলি থেকে বেরিয়ে ‘কমন বাইল ডাক্ট‘ এর মাধ্যমে খাদ্যনালীতে চলে আসে। অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস এর ক্ষেত্রে এই কমন বাইল ডাক্ট-এ পাথর এসে জমা হয়, তখন বাইল শরীর থেকে বের না হতে পেরে শরীরে বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে জন্ডিস সৃষ্টি করে। এবং এই জন্ডিসে সাধারনত বিলিরুবিন এর পরিমান অন্যান্য জন্ডিস এর থেকে বেশি হয়, এবং হেপাটোরেনাল সিন্ড্রোম (যেখানে লিভার ফেলর হোয়ার পর কিডনী ফেইলর হয়) বা হেপাটিক এনকেফালোপ্যাথি(বিলিরুবিন বেড়ে গিয়ে ব্রেন এ এঙ্কেফালোপ্যাথি) হওয়ার মাধ্যমে মানুষ মারাও যেতে পারে।
৩ প্যানক্রিয়েটাইটিস তথা অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ – পিত্তথলির পাথর কমন বাইল ডাক্ট থেকে নেমে প্যানক্রিয়েটিক ডাক্ট এ আটকে গিয়ে একিউট প্যানক্রিয়েটাইটিস তথা অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যাতে হঠাৎ পেটের মাঝ দিকে তীব্র ব্যথা সৃষ্ট হতে পারে, সাথে প্রচুর বমি হতে পারে, এবং ব্যথা পেটে হওয়ার সাথে সাথে পিঠেও হতে পারে। এবং এতই ব্যথা সৃষ্ট হবে যে রোগিকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, তাছাড়া যেকোনো বিপদ হতে পারে।
৪ পিত্তথলিতে ক্যান্সার – যদিও পিত্তথলিতে ক্যান্সার অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় কম হয়। কিন্তু পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার জন্য পরবর্তিতে সেখানে ম্যালিগন্যান্সি তথা ক্যান্সারও হতে পারে।
(ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত)
No comments:
Post a Comment